রাওলাট আইন

  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার দমন পীড়নের মাধ্যমে সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কন্ঠরোধ এবং ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলন দমনে সচেষ্ট হন ।
  • এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার বিচারপতি রাউলাটের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ‘সিডিশন কমিশন’ [Sedition Commission] গঠন করেন ।
  • ইংল্যান্ডের বিচারপতি সিডনি রাওলাট ছিলেন এই কমিটির সভাপতি । এই কারণে এই কমিটি রাওলাট কমিটি নামেই বেশি পরিচিত ।
  • ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে রাওলাট কমিটি তার প্রতিবেদন পেশ করে । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি কমিটির সুপারিশগুলি বিল হিসেবে কেন্দ্রীয় আইন সভায় উত্থাপিত হয় এবং ১৮ মার্চ , ১৯১৯ খ্রি. তা আইন হিসেবে পাস হয় । এটিই রাওলাট আইন নামে কুখ্যাত ।
  • এই আইনটির আসল নাম ছিল — ‘দ্য অ্যানার্কিক্যাল অ্যান্ড রেভল্যুশনারি অ্যাক্ট ' ( The Anarchical and Revolutionary Act ) ।

রাওলাট আইনের শর্ত

  • সরকার বিরোধী যে-কোনো প্রচারকার্যকে দন্ডনীয় অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয় ।
  • কোনো রকম সাক্ষ প্রমাণ ছাড়াই যে-কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় ও বিনাবিচারে গ্রেফতার ও যতদিন খুশি আটকে রাখা যাবে ।
  • কোনাে সন্দেহজনক ব্যক্তির ঘরবাড়ি বিনা গ্রেফতারি পরােয়ানায় তল্লাশি চালানাে যাবে ।
  • কোনােরকম সাক্ষ্য – প্রমাণ ছাড়াই বিচারক বিচারের কাজ করতে পারবেন ।
  • বিচারকরা বিচারে যে রায় দেবেন , অপরাধীরা সেই রায়ের ওপর উচ্চ আদালতে কোনাে আপিল করতে পারবে না ।
  • সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর বিভিন্ন নিষেধ আরােপ করা হবে ।

রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ :-

  • দেশব্যাপী প্রতিবাদঅত্যাচারী রাওলাট আইনকে কেন্দ্র করে দেশের সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়।
  • পত্রপত্রিকায় :অমৃতবাজার পত্রিকা, হিন্দু, দ্য নিউ ইন্ডিয়া, বোম্বাই ক্রনিক্যাল, কেশরী প্রভৃতি পত্রিকা এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
  • আইনসভার সদস্যদের : কেন্দ্রীয় আইন সভার সমস্ত ভারতীয় সদস্য প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন । মদনমোহন মালাব্য, মহম্মদ আলি জিন্নাহ, মাজহার উল হক আইন পরিষদের সদস্য পদে ইস্তফা দেন ।
  • রাওলাট সত্যাগ্রহ :এই ঘৃণ্য ‘কালা আইন ’ – এর তীব্র প্রতিবাদ করে বড়ােলাট লর্ড চেমসফোর্ডকে তা কার্যকারী না করার অনুরােধ জানান গান্ধিজি । আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে গান্ধিজি এই আইনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ভারতব্যাপী সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেন ।
  • জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড রাওলাট আইন ও পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকারের দমনমূলক নীতির প্রতিবাদে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল বিকেল সাড়ে চারটার সময় অমৃতসর শহরের পূর্বপ্রান্তে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে এক উদ্যানে প্রায় দশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ শান্তিপূর্ণ সভায় মিলিত হয় । পুলিশ বিনাপ্ররোচনায় জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এই ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড' নামে খ্যাত।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড

  • ১৯১৯ খ্রিঃ মার্চ মাসে, শুধুমাত্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ রোধ করার জন্য কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রবর্তন করা হলে, দেশবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
  • রাওলাট আইনকে কেন্দ্র করে গান্ধিজির আহ্বানে সারাদেশ গণ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়লে ব্রিটিশ সরকার গুলির বিনিময়ে তাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে ।
  • রাওলাট আইনের প্রতিবাদের জন্য people’s committee নামক একটি সংগঠন লাহোর ও অমৃতসরে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
  • ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল, অমৃতসরের স্থানীয় দুই নেতা সৈফুদ্দিন কিচলু ও ড. সত্যপালকে হিংসায় মদত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করলে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
  • ১০ই এপ্রিল মধ্যাহ্নে গান্ধীজি গ্রেপ্তার হন এবং লাহোর শহরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়।
  • গান্ধীজি ও পাঞ্জাবের নেতৃদ্বয়ের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে অমৃতসর শহরে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা বের হলে পুলিশ তার উপর গুলি চালায়। এর ফলে বহু লোক হতাহত হয়।
  • রাওলাট আইন বিরোধী আন্দোলন অমৃতসরে প্রবল হয়ে উঠলে সেখানকার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনির হাতে অমৃতসরের শাসন ভারের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়।
  • পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার মাইকেল ও ডায়ার পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি করে ওই শহরে জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করেন।
  • ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল বিকেল সাড়ে চারটার সময় অমৃতসর শহরের পূর্বপ্রান্তে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে এক উদ্যানে প্রায় দশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ শান্তিপূর্ণ সভায় মিলিত হয় ।
  • তাদেরকে কোনােভাবেই সতর্ক না করে ডায়ারের নির্দেশে ১৬৫০ রাউণ্ড গুলি চালনো হয়।
  • সরকারি মতে নিহতের সংখ্যা ৩৭৯ ও আহতের সংখ্যা ছিল ১২০০ জন, কিন্তু অনেকের মতে প্রায় সহস্রাধিক লোক এতে নিহত হয়।
  • বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঘৃণাভরে তাঁর "নাইটহুড" উপাধি বর্জন করেন ।
  • ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব উধাম সিং মাইকেল ও'ডোয়াইয়ার-কে (Michael O'Dwyer) হত্যা করার সঙ্কল্প করে ১৯৩৪ সালে বিলেত গমন করেন এবং ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে - জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রায় ২১ বছর পরে - লন্ডনের এক সভাকক্ষে গুলি করে হত্যা করেন।
  • গান্ধীজি তাঁর ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় লেখেন, “এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে ধ্বংস করতেই হবে”।
  • রাওলাট আইনের প্রতিবাদে গান্ধীজি যে সত্যাগ্রহের কর্মসূচি নিয়েছিলেন তাতে হিংসার প্রবেশ দেখে তিনি মর্মাহত হন। এই কারণে রাওলাট সত্যাগ্রহের কর্মসূচিকে তিনি ‘হিমালয়-সদৃশ প্রমাদ’ বলে অভিহিত করেন এবং ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল তিনি এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।